Women friendly work environment should be created: Nupur Biswas

নূপুর বিশ্বাসের জন্ম ও বেড়ে ওঠা চাঁদপুর শহরের গুয়াখোলায়। তিনি চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেন। এরপর শিক্ষকতা পেশায় যাত্রা শুরু করেন। দীর্ঘ ১৮ বছর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন। বর্তমানে তিনি চাঁদপুরের পুরান বাজার ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।

নারী দিবস উপলক্ষে কর্মক্ষেত্রে সফল এ শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—

জাগো নিউজ: ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
নূপুর বিশ্বাস: নারী দিবস পালনের ইতিহাস বলে—এটি মূলত নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। ১৮৫৭ সালে কর্মক্ষেত্রে নারীর মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা ও কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। দেখা যায়, নারী দিবসের গোড়ার বিষয়টিই ছিল কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকার আদায়। ১৬৯ বছর আগে নারীর এই প্রতিবাদ নিঃসন্দেহে এক বিস্ময়কর ঘটনা এবং প্রশংসার দাবী রাখে। আর এ বছরের নারীর দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে—‘নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’। মূলত নারীর সমঅধিকার ও সমসুযোগ প্রাপ্তির বিষয়টিকে আমি পুরোপুরি সম্মানের মনে করি না। কারণ আমার চোখে পুরুষ ও রমণী কোনো ভেদাভেদ নেই। কারণ আমি নারীবাদী বা পুরুষবাদী নই, আমি মানুষবাদী। শুধু নারীকেই কেন সমঅধিকার ও সমসুযোগ আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে হবে? আমরা আন্দোলন করবো নারী বা পুরুষ নয়, মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। না হলে নারী হবে শুধুই করুণার পাত্র। পুরুষকে অধিকার দাতা বানিয়ে এখানেও নারীকে ছোট করা হচ্ছে। আমার মতে, এই দিবস পালনের বিশেষত্ব হোক নারী-পুরুষ উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। সেটির প্রথম ধাপই হচ্ছে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে উভয়ের পক্ষ থেকে উভয়েই চিন্তা করবে, আমি যা তুমিও তা। আমরা সবার আগে মানুষ। আমরা কেউ কাউকে সুযোগ বা অধিকার দেবো না, আমরা অধিকার আদায়ের জন্য লড়বো। ‘সবাই মিলে ভাবো নতুন কিছু করো; নারী পুরুষ সমতার নতুন বিশ্ব গড়ো।’

জাগো নিউজ: নারীরা অধিকার আদায়ের পাশাপাশি সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে কী?
নূপুর বিশ্বাস: নারীরা তাদের অধিকার একেবারেই প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি বললে ভুল হবে। নারীর পেছনের অমানবিক ও মানবেতর জীবনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বর্তমানে নারী তার বিদ্যা, বুদ্ধি, শিক্ষা, শ্রম, কর্মনিষ্ঠা ও বিবেচনা বোধ দিয়ে তাদের অধিকার আদায় কিছুটা হলেও করতে পেরেছে। তা ছাড়া আগের তুলনায় নারীর শিক্ষার হার বেড়েছে। তারা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পেশায় আসছে, সমাজ-রাষ্ট্রের বিভিন্ন উন্নয়নে স্বপ্রণোদিত হয়ে অংশগ্রহণ করছে। সবচেয়ে আশার কথা—আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, এমপি থেকে জেলা প্রশাসক ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নারী। তবে নারীর প্রতি সবরকম বৈষম্য ও অন্যায় অবিচারের অবসান করে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা এখনো পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। কারণ সাম্য প্রতিষ্ঠার পেছনে শুধু পুরুষকে নয়, নারীকেও কিছুটা দায়ী করব। পুরুষ নারীকে যতটা অসম্মান করে, নারী নারীকে তার চেয়ে বেশি অসম্মান করে। এর জন্য প্রয়োজন নারী পুরুষের বিশুদ্ধ শিক্ষা, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সমৃদ্ধ সুন্দর একটি মানসিকতা গঠন।

জাগো নিউজ: আপনি বেশ কয়েক বছর শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত। নারী হিসেবে কর্মক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন কি?
নূপুর বিশ্বাস: আমি বিগত আঠারো বছর এই মহান পেশার সঙ্গে যুক্ত। পুরান বাজার ডিগ্রি কলেজ আমার পঞ্চম কর্মক্ষেত্র। সব সময় একটি কথা বলি, কারো কর্মস্থল মনের মতো না হলে একধরনের আধ্যাত্মিক কষ্ট হয়। নারীর ক্ষেত্রে এর মাত্রা আরও বেশি হয়। আমি কর্মজীবনের শুরুতে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলেও এখন অনেকটাই অতিক্রম করতে পারি। একুশ শতকে এসেও কিছু পুরুষ সহকর্মী, একজন নারী তার সহকর্মী; এটা মন থেকে মেনে নেয় না। এতে কর্মক্ষেত্রে অতি সূক্ষ্মভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এর জন্য তারা বেগম রোকেয়ার আবির্ভাবকে দায়ী করতেও পিছপা হন না। তাদের যুক্তি, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় তার সোচ্চার হওয়ার কারণেই ঘর-সংসার ফেলে নারী আজ কর্মক্ষেত্রে। তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছে এবং প্রতিযোগিতার দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর বলেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

জাগো নিউজ: বর্তমানে কর্মপরিবেশ কতটা নারীবান্ধব বলে আপনি মনে করেন?
নূপুর বিশ্বাস: সর্বক্ষেত্রে নারীর কর্মপরিবেশ একরকম নয়। সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে একরকম, প্রাইভেট বা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং কর্মক্ষেত্রে একরকম। কর্ম পরিবেশকে নারীবান্ধব করতে স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানকে ব্যবস্থা নিতে হবে। নারীকে নারী না ভেবে মানুষ ভেবে তার যাতে সম্মানহানী না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রেখে প্রত্যেক কর্মক্ষেত্রে নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। যাতে নারী তার কর্মস্থলকে মনে করে এক টুকরো খোলা আকাশ। যেখানে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। তবেই সে সুচারুরূপে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে আন্তরিক হবে।

আরও পড়ুন

বিসিএস একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া: শুভ রায় সুমন
বাবার পরিশ্রমই সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা: রহমত উল্লাহ
জাগো নিউজ: আমাদের সমাজে গৃহিণীদের ভূমিকা নিয়ে আপনার অভিমত কী?
নূপুর বিশ্বাস: গৃহিণী বলতে যদি গৃহকর্ত্রী, পত্নী বা স্ত্রীকে বোঝায়, তাহলে যে নারী বাইরে কাজ করে সেও কিন্তু গৃহিণী। আর গৃহিণী বলতে যদি ঘরকন্নার কাজ করা নারীদেরই বুঝি তাহলে বলবো, তাদের ভূমিকা নিয়ে আমার মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ইতিবাচক। প্রথমেই গৃহিণীদের অবমূল্যায়ন করার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। পরিবারের জন্য তাদের যে ত্যাগ, শ্রম তার মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ সংসারে একজন সুনিপুণ, পরিশ্রমী মায়াবতী মা-ই পারেন তার সন্তানকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে। তাই গৃহিণীর অবদানকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। বর্তমানে গৃহিণীরাও বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে নিজের ভেতরের কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও দশের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করছেন।

জাগো নিউজ: বর্তমানে শিক্ষকতা পেশায় নারীদের মূল্যায়ন বা অবস্থান কেমন?
নূপুর বিশ্বাস: শুধু শিক্ষকতা পেশায় কেন নারী শিক্ষিত, ব্যক্তিত্বময়ী, সৎ ও কর্মনিষ্ঠ হলে; যে কোনো পেশায় তার মূল্যায়ন বা অবস্থান হবে সুদৃঢ়। একজন পুরুষ শিক্ষকের তুলনায় একজন নারী শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মনে আগে জায়গা করে নিতে পারেন। সেটা প্রাথমিক বা উচ্চশিক্ষা, যেখানেই হোক। কারণ সেখানে তারা শিক্ষকের সাথে সাথে একজন মমতাময়ী মাকেও প্রত্যক্ষ করে।

জাগো নিউজ: ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে নারীরা কীভাবে অবদান রাখবেন?
নূপুর বিশ্বাস: ‘২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ’—বিষয়টিই আগে দেশের নারী-পুরুষ উভয়কে জানতে হবে, আত্মস্থ করতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের চারটি স্তম্ভ—স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট ইকোনমি এবং স্মার্ট সোসাইটি। প্রথম ও শেষ স্তম্ভ স্মার্ট সিটিজেন ও স্মার্ট সোসাইটি; যার উৎপত্তিই হয়েছে পরিবার থেকে। আর সেই পরিবারের সার্বিক নিয়ন্ত্রণকারী হচ্ছেন একজন নারী বা মা। তিনি যদি তার সন্তানকে সমাজে একজন যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে না পারেন। তবে স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট বিনির্মাণ সুদূর পরাহত। এজন্য প্রথমেই দরকার নারীকে প্রযুক্তির আওতায় নিয়ে আসা।

জাগো নিউজ: উচ্চাশিক্ষার ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে বা নারী শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণ সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?
নূপুর বিশ্বাস: উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নারীদের পিছিয়ে থাকার কারণটির জন্য আমি পুরোপুরি পরিবারকেই দায়ী করবো। এইচএসসি শেষ করে যেসব নারী সম্মান শ্রেণিতে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হন। তাদের সেই স্বপ্ন এক বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। তাদের একটাই অভিযোগ, পরিবার থেকে তাদের পড়াশোনা বন্ধের জন্য মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হয় এবং বিয়ে করে ঘর-সংসার করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। এখানে অভিভাবকের আর্থিক দীনতার চেয়ে মানসিক দীনতাই বেশি কাজ করে। তারা ভাবেন, মেয়ে মানুষকে এত শিক্ষিত করে লাভ কী? স্বপ্ন দেখানো একজন শিক্ষকের পক্ষে শিক্ষার্থীর স্বপ্নভাঙার এ দৃশ্য দেখা সত্যিই কষ্টের।

জাগো নিউজ: যেসব নারী শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান, তাদের নিয়ে কী বলতে চান?
নূপুর বিশ্বাস: যেসব নারী শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান, তাদের উদার চিত্তে স্বাগত জানাবো। কারণ নারীর জন্য এটি একটি নন্দিত পেশা। সে যদি নিজেকে জ্ঞানে-কর্মে, নিষ্ঠায়-সততায় ও ব্যক্তিত্বে সমৃদ্ধ করতে পারে। তাহলেই পরিবার-সমাজ তথা রাষ্ট্রের কাছে সে হবে বরণীয়। মাথা উঁচু করে বিধাতাকেও বলতে পারবে—
‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার;
কেন নাহি দিবে অধিকার? হে বিধাতা।’

পরিশেষে বলবো, ৮ মার্চে নারী দিবসের তাৎপর্য হোক—আঁতুড়ঘর ও রান্নাঘর থেকে শিক্ষাব্রতে, কর্মযজ্ঞে, আন্দোলনে, উগ্রপন্থে, অগ্নিপথে, যুদ্ধ জয়ে, দাঙ্গা ক্ষেত্রে, লিঙ্গ বৈষম্যের জয়ে এবং শ্রেণি সাম্যে নারী তোমার জয় হোক। ধন্যবাদ।