মেয়ের বাড়ি থেকে কি দিল? বিয়ের পর ছেলের আত্মীয়দের এটা খুব কমন প্রশ্ন। এমনভাবে জিজ্ঞাসা করবে, যেন মেয়ের বাড়ি থেকে কিছু পাওয়া ছেলের পরিবারের জন্মগত অধিকার। চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চল তো আরও একধাপ উপরে…বাংলাদেশের মধ্যে ধর্মীয় অনুভুতির দিক থেকে এই দুই বিভাগের লোক এগিয়ে… কিন্তু এই দুই এলাকাতেই এই কুপ্রথা প্রবল।
বিয়ের সময় ছেলে পক্ষের হাজার লোক খাওয়াতে হবে, মণকে মণ ছেলের বাড়িতে মিষ্টি দিতে হবে, সে মিষ্টি আবার কম দামী হলে এলাকায় মানসম্মান থাকবে না, তাই বেশি দামী হতে হবে।
বিয়ের পর কুরবানি ঈদে মেয়ের বাড়ি থেকে গরু গিফট কিংবা জ্যেষ্ঠ মাসে ট্রাক ভর্তি ফল-ফলাদি না দিলে ছেলেপক্ষের মান ইজ্জত থাকে না. এমনকি পবিত্র রমজানের সময় ভ্যানভর্তি ইফতার ছেলেপক্ষের বাড়িতে না পাঠালে, জাত গেল জাত গেল বলে রব উঠে!
মেয়ের বাড়ি থেকে ফার্নিচার না দিলে বরপক্ষ সমাজে মুখ দেখাতে পারে না!! পাত্র কিছু না চাইলেও, তার মুরুব্বিরা এদিক থেকে একধাপ এগিয়ে থাকে। বিয়ের পরপরই মেয়ের সাথে বাড়ি ভর্তি ফার্নিচার না গেলে, সে মেয়ের আজীবন খোঁটা শুনতে হয়। আর খোঁটা দেওয়ার জন্য কিছু মহিলা সম্প্রদায় যেন রেডি হয়েই থাকে।
যদি মেয়ের পরিবার কিছু দেয়ও, তখন শুরু হয় তুলনা, বোনের ছেলে বিয়ে করে বাড়ি ভর্তি ফার্নিচার পেল, আমার ছেলে বিয়ে করে মাত্র একটা খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল আর দুটো সোফা পেল!! অনেক এটাকে ট্রেডিশন বলে, অনেককেই দেখেছি এটা নিয়ে গর্ব করে. কিন্ত একটা জাহেলি যুগের প্রথা কিভাবে মুসলিম দেশের ট্রেডিশন হতে পারে, সেটাই মাথায় আসে না।
অথচ, ইসলাম ধর্মে মেয়ের পরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠান করে খাওয়ানো (ওয়ালিমা) এর ব্যাপারে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এই খাওয়ানোর বাধ্যবাধকতা সম্পুর্ন ছেলের পরিবারের উপর।
আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা) এর বিয়ের খবর শুনে রাসুল (সা) তাকে বলেন, “ওয়ালিমার আয়োজন করো, যদিও তা একটিমাত্র ছাগল দ্বারা হয়”। (সহিহ বুখারি) রাসুল (সা) নিজেও বিয়ের ওয়ালিমা বা ভোজের আয়োজন করেছেন, সাহাবীদেরকেও অল্প পরিসরে হলেও তা করার নির্দেশ দিয়েছেন । কিন্তু কোন নারীদের এ বিষয়ে কিছু নির্দেশ দেননি।
এরপরেও কোন মেয়ের পরিবার যদি নিজের ইচ্ছেয় খাওয়াতে চায়, সেটা তাদের ঐচ্ছিক ব্যাপার। কিন্তু অনুষ্ঠান করার জন্য, লোক খাওয়ানোর জন্য মেয়ের পরিবারের উপর জোর করে কোন শর্ত বা বোঝা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। সারা বাংলাদেশেই বিয়ে উপলক্ষে লেনদেন প্রথা বেশ জনপ্রিয়.
অথচ বিয়ের সময় শর্ত হিসেবে মেয়ের পরিবারের কাছে থেকে কিছু তো নেওয়া যাবেই না, বিয়ের পরেও জোর করে কোন কিছু আদায় করা যাবে না… সেটা যৌতুক বা গিফট- যে নামেই হোক না কেন… ইসলামে এটি নিষিদ্ধ। বরং বিয়ের সময় স্বামী উল্টো স্ত্রীকে দিতে বাধ্য থাকবে যেটার নাম মোহরানা। এটি দেওয়া ফরজ, যার আদেশ স্বয়ং আল্লাহ তায়া্লা কোরআনে দিয়েছেন-
“তোমরা খুশি মনে স্ত্রীকে মোহর পরিশোধ করো।” (সূরা আন নিসা: ৪) এখানেই শেষ নয়. বাকি জীবন স্ত্রী ও বাচ্চার ভরণ পোষণসহ পারিবারিক সকল অর্থনৈতিক দায়িত্ব স্বামীর একার। এমনকি স্ত্রী যদি স্বামীর অনুমতিক্রমে চাকুরীও করে, সেই ইনকামে স্বামীর কোন অধিকার নেই। স্ত্রী চাইলে সেটা নিজের জন্য খরচ করতে পারে কিংবা সংসারেও কাজে লাগাতে পারে. সেটা তার সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছা। তবে স্ত্রীর পরিবার নিজেদের ইচ্ছায় ছেলেকে কোন কিছু দিতে চাইলে সেটা নেওয়া বৈধ. কারণ এটা উপহার. যে কেউ যে কাউকে উপহার দিতে পারে… বন্ধু বন্ধুকে, স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে, প্রতিবেশি আরেক প্রতিবেশীকে. ইত্যাদি ইত্যাদি… এতে সম্প্রীতি বাড়ে। এটা ভিন্ন ব্যাপার।
তবে, “আমি বিয়ে করেছি, মেয়ের বাবা এখন আমাকে উপহার দিবে” মনে মনে এমন প্রত্যাশা করলে, সেটা আর উপহার থাকে না, বরং এমন প্রত্যাশা ত্যাগ করা উচিত। এতে অন্তরে লোভ তৈরি হয়।
একজন মেয়ে আপনার সংসারে আসছে, সংসার সামলিয়ে রাখছে, আপনার বাচ্চাকে দশ মাস পেটে রেখে জন্ম দিয়ে বংশরক্ষা করছে, তিনবেলা রান্না করে খাওয়াচ্ছে, নিজে রান্না করার পরেও আপনি বাসায় না ফেরা পর্যন্ত না খেয়ে অপেক্ষা করছে, অফিস থেকে ফিরে নোংরা হয়ে যাওয়া কাপড় পর্যন্ত ধুয়ে পরিস্কার করে দিচ্ছে. এগুলোই তো অনেক বেশি কিছু পাওয়া. যে মেয়েটি এতো কিছু করছে, তার কাছ থেকে বিয়ে উপলক্ষ্যে গিফট বা যৌতুক কিভাবে আশা করা যায়? বরং আমাদের উচিত সেই মেয়েটিকেই বাকী জীবন সুখে রাখার চেষ্টা করা.বিয়ের পর একজন মেয়ে তার সবকিছু ছেড়ে আপনার কাছে আসে, যে মেয়ে এমন স্যাক্রিফাইস করে আসে, সে নিজেই তো আমাদের জন্য জীবনের সবচেয়ে বড় গিফট।