স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরি করে বাবা-মার কষ্ট দূর করবেন শ্রাবণ। কিন্তু এক ঝড়েই সেই স্বপ্ন নিমিষেই অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। স্নাতকের শিক্ষার্থী মেরাজ উদ্দিন শ্রাবণ পোশাকশ্রমিক বাবাকে সহায়তা করতে নিজেও টেকনিশিয়ান হিসেবে কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন গত ৭ মাস আগে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে তাঁর ডান চোখ, মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশে ছররা গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ মেরাজের অন্য চোখে বুট দিয়ে আঘাত করে পুলিশ। শরীরের গুলি বের হলেও চোখের ভেতরে ও মাথায় এখনো আটকে আছে গুলি। গুলিবিদ্ধ চোখে আলো নেই। ফিরবে কি না সেটাও অনিশ্চিত।
মেরাজের বাড়ি ময়মনসিংহ নগরীর জেল রোড কাশর এলাকায়। বাবার নাম মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে মেরাজ বড়। নগরীর আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি।
বাবা মিনহাজ উদ্দিন গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেন। পরিবার নিয়ে কোনাবাড়ী এলাকায় থাকেন। অভাবের সংসারে সহায়তা করতে সাত মাস আগে একটি পোশাক কারখানায় টেকনিশিয়ানের কাজ নেন মেরাজও।
সেই দিন তার সাথে ঘটে যাওয়া লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন মেরাজ। পাশে বসে কাঁদছিল তার বাবা-মা। ছেলের এমন পরিণতি হবে কল্পনাও করতে পারেননি তাঁরা।
মেরাজ বলেন, ৫ তারিখ আমরা কোনাবাড়ি থেকে ঢাকার দিকে যাচ্ছিলাম, যখন আমরা চৌরাস্তার দিকে যাচ্ছি তখন পুলিশ আমাদের প্রতিহত করার জন্য ব্যারিকেট দেয়, আমরা তখন পেছনের দিকে সরে আসি। তখন আনুমানিক সকাল ১০ টা বা সাড়ে ১০ টা এরকম সময় হবে, তখন আমাদের সামনে প্রায় দুই আড়াইশ তিনশো পুলিশ ছিল, তখন পুলিশের মাঝখানে ২ টা গুলির আওয়াজ শোনা যায়, পরে দেখি সবাই একসঙ্গে গুলিবর্ষণ শুরু করে, এসময় আমার সাথে ৪/৫ জন ছিল আমরা সবাই বসে পড়ি, চারদিকে তাকিয়ে দেখি যারাই দৌড় দিয়েছে সবাই স্পটডেথ হয়ে গেছে, প্রায় ৩০/৪০ জন হবে। আমার দৌড় দেয়ার সাহস হচ্ছিল না, আমরা রাস্তায় শুয়ে পড়ি। যখন দেখলাম গুলিবর্ষণ একটু থেমে গেছে, ঐ মুহূর্তে যখন আমরা ওঠে পালানোর চেষ্টা করি, তখন পুলিশ আমাদের উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ শুরু করে, ঐ মুহূর্তে আমার শরীরে, হাতে, আর চোখে গুলি লাগে, তখন আমার শরীর নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল আমি রাস্তায় শুয়ে পড়ি, পুলিশ এসে আমার চোখে মুখে বুট জুতা দিয়ে এলোপাতাড়ি লাথি দিতে থাকে এরপর আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখি আমি একটি অন্ধকার রুমে আবদ্ধ, আমার চারপাশে কারও হাত, কারও পা, কারও মাথা লাশের স্তুপের মধ্যে আমি আটকে আছি, চারদিকে লাশ আর লাশ, আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠি, আমার চিৎকার শুনে বাহিরে থাকা পুলিশ সদস্যরা ভেতরে ঢুকে আমাকে টেনেহিঁচড়ে বের করে, পরে আমাকে প্রাণ ভিক্ষা দিয়েছে বলে রাস্তায় নিয়ে ফেলে দিয়ে আসে। কথাগুলো বলতে বলতে কেঁপে উঠছিল শ্রাবণ। সেই দিনের ঘটনা এখনো তাকে তাড়া করে বেড়ায়, ঘুমের মধ্যে চিৎকার দিয়ে ওঠে।
ছেলের চিকিৎসার কাগজ দেখাচ্ছিলেন বাবা মিনহাজ উদ্দিন। সিটি স্ক্যান ও এক্স-রেতে দেখা যায়, মেরাজের ডান চোখের ভেতরে দুটি ও মাথায় চারটি গুলি এখনো থেকে গেছে। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছে।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, চোখের গভীরে চলে গেছে গুলি। অস্ত্রোপচার করে বের করতে গেলে চোখ একেবারে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
হাসপাতালে চিকিৎসার সময় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম মেরাজকে দেখতে গিয়েছিলেন। দিয়েছিলেন সুচিকিৎসার আশ্বাস।
মেরাজের বাবা মিনহাজ উদ্দিন জানান, আমার ছেলের চোখের যে অবস্থা তাতে করে দেশে চিকিৎসা করিয়ে কোন উন্নতি হবে না। আমার অর্থনৈতিক যে অবস্থা তাতে করে ৫/৭ লাখ টাকা খরচ করে ছেলেকে বিদেশে চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। ‘ছাত্রনেতাদের কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম, দেশের বাইরে নিয়ে যেন আমার ছেলের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কারণ, চিকিৎসকদের কথায় বুঝতে পেরেছি, দেশের চিকিৎসায় ছেলের চোখের আলো হয়তো আর ফিরবে না।
মেরাজের মা শান্তনা ইসলাম জানান, স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগের মাধ্যমে আমাদের দেশ আবারও স্বাধীন হয়েছে। আমার ছেলে সেই যুদ্ধের একজন অকুতোভয় সৈনিক ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আবেদন জানাই, আমার ছেলের সুচিকিৎসার জন্য যদি দেশের বাইরেও নিতে হয়, তা যেন করা হয়।