বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে না পারার ক’ষ্টে মেধা যাচাই করতে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেন। প্রথমবারেই বাজিমাত করেছেন তিনি। সবাইকে তাক লাগিয়ে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ৩৮তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হন নিগার সুলতানা জিনিয়া। ৩৮তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সারাদেশের মধ্যে তার সাবজেক্টে ১৮৯তম হয়েছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযু’ক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চ’ম ব্যাচের শিক্ষার্থী
নিগার সুলতানা জিনিয়া। তিনি কুমিল্লার চান্দিনা উপজে’লার বাসিন্দা হলেও বর্তমানে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজে’লার মৎস্য কর্মক’র্তার কার্যালয়ের সম্প্রসারণ কর্মক’র্তা। কুমিল্লার চান্দিনা উপজে’লার ডা. ফিরোজা পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শুরু করেন জিনিয়া। ছোটবেলা থেকে লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়ায় অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পান। এ সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে শুরু হয় জিনিয়ার পথচলা। ২০০৭ সালে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ এবং মেধাতালিকায় বোর্ডের
অধীনে বৃত্তি পান। এরপর ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে। একাদশ শ্রেণিতেও ভালো ফলাফলের চেষ্টা অব্যাহত থাকে। ২০০৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ পেয়ে একই বোর্ডের অধীনে বৃত্তি পান জিনিয়া। এরপর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযু’ক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগে ভর্তি হন। ২০১৩ সালে বিএসসি পরীক্ষায় সিজিপিএ-৩.৮৬ পেয়ে ফার্স্ট ক্লাস থার্ড হন জিনিয়া। ২০১৬ সালে এমএসসি পরীক্ষায় বাংলাদেশ কৃষি
বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগ থেকে সিজিপিএ-৩.৮৪ এবং ফার্স্ট ক্লাস থার্ড হন তিনি। নিজের বেড়ে ওঠা দিনগুলোর কথা স্ম’রণ করে নিগার সুলতানা জিনিয়া বলেন, ছোটবেলা থেকে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। কারণ বাবা-মা স্বাস্থ্য বিভাগে কর্ম’রত। বাবা মো. জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া চান্দিনা উপজে’লা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান সহকারী (কাম হিসাবরক্ষক)। মা তাহমিনা আক্তার স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক। বাবার সততা আর মায়ের
জনসেবামূলক কর্মকা’ণ্ডে অনুপ্রা’ণিত হয়ে ছোটবেলা থেকেই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন লালন করতাম আমি। ‘অবশ্য পড়াশোনা সম্পন্ন করে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযু’ক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তুু কপালে ছিল না। শিক্ষক হতে পারিনি। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্ট ক্লাস থার্ড হয়েছি আমি। শিক্ষক হতে না পেরে মনে প্রচণ্ড আ’ঘাত পেয়েছি। ক’ষ্ট পেয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি; আরও বড় পরিসরে নিজের মেধার পরীক্ষা দেব। তখনই মা’থায় এলো
বাংলাদেশে মেধা যাচাইয়ের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম বিসিএসের কথা’ জাগো নিউজকে বলছিলেন নিগার সুলতানা জিনিয়া। স্বপ্ন ছোঁয়ার কথা জানিয়ে জিনিয়া বলেন, ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পাসের পর চলে আসি গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। এরপর শুরু হয় বিসিএসের প্রস্তুতি। ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিই। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। কারণ পরীক্ষা দিয়েই বুঝতে পারলাম আমি পাস করব। এরই
মধ্যে ফলাফলে প্রিলিতে উত্তীর্ণ হওয়ার খবর পেয়ে যাই। বিসিএস জয়ের চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে জিনিয়া বলেন, প্রিলির প্রায় আট মাস পর ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা দেই। তারও প্রায় এক বছর দুই মাস পর ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর মৌখিক পরীক্ষা দেই। লিখিত পরীক্ষার এক বছর দুই মাস পর মৌখিক পরীক্ষা দেয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে। বিশেষ করে সমসাময়িক সব বিষয় পড়তে হয়েছে। দেশ, আন্তর্জাতিক, অর্থনীতি, সরকার, মহান মুক্তিযু’দ্ধ ও
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব বিষয় আয়ত্ত করতে হয়েছে। দিনরাত ১২-১৩ ঘণ্টা লেখাপাড়া করতে হয়েছে আমাকে। এভাবেই তৈরি হয় বিসিএস জয়ের পথ। ‘এরই মধ্যে আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য বার বার তাগাদা দিতে শুরু করেন বাবা-মা। এ অবস্থায় আমি তাদের কাছে অন্তত দুই বছর সময় চেয়ে নিয়েছি। তারাও আমা’র ইচ্ছার বি’রুদ্ধে কথা বলেননি। মা ছোটবেলা থেকে আমাকে বলতেন তুমি যতদূর পড়তে চাও; পড়াব। কিন্তু পড়ার মতো পড়তে হবে। মায়ের
কথাগুলো আমাকে প্রতি মুহূর্তে অনুপ্রেরণা দেয়’ বলছিলেন জিনিয়া। সাফল্যের অনুভূতি জানিয়ে জিনিয়া বলেন, আমা’র মনেপ্রা’ণে, ধ্যানে একটাই প্রার্থনা ছিল; আল্লাহ যেন আমা’র মেধার মূল্যায়ন করেন। অবশেষে মহান আল্লাহ আমা’র মনের ইচ্ছা পূরণ করলেন। বড় পরিসরে স্বপ্নপূরণ করে দিলেন আল্লাহ। কারণ আমি চেয়েছি শিক্ষক হতে; আর আল্লাহ আমাকে পরিসর বাড়িয়ে ম্যাজিস্ট্রেট বানিয়ে দিলেন। আল্লাহর কাছে অনেক অনেক শুকরিয়া। পাশাপাশি মা-বাবাসহ পরিবারের সব সদস্য,
আত্মীয়-স্বজন সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আমা’র পড়ালেখা ও এতদূর আসার পেছনে সবচেয়ে বেশি ক’ষ্ট করেছেন আমা’র মা। আমা’র মায়ের ক’ষ্ট সার্থক হয়েছে আজ। আমা’র মাকে হাজারো সালাম। চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযু’ক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচ’মেট আবু কায়সার দিদারকে বিয়ে করেন নিগার সুলতানা জিনিয়া। তার স্বামী নিজের অডিট ফার্মের সিনিয়র ইনভেস্টিগেটর। বিয়ের বিষয়ে জিনিয়া বলেন, আমা’র স্বামী আগে আমা’র
বন্ধু, তারপর স্বামী। বিসিএসের প্রস্তুতির শুরু থেকে আমাকে সহযোগিতা করেছে দিদার। আগে বন্ধু হিসেবে পাশে ছিল, এখন স্বামী হিসেবে আছে। আপনার যেকোনো সাফল্যের জন্য একজন বন্ধু পাশে থাকা চাই। আমা’র সাফল্যে আমা’র স্বামী ভীষণ খুশি। পাশাপাশি তার পরিবারের সবাইও খুশি। নিগার সুলতানা জিনিয়ারা দুই বোন এক ভাই। জিনিয়া মেজো। বড় বোন আজমেরী সুলতান পাপিয়া এলএলবিতে অধ্যয়নরত। ছোট ভাই মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া (মাহিন) কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ
বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত। ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা নিয়ে নিগার সুলতানা জিনিয়া বলেন, আমি ন্যায় ও নিষ্ঠার সঙ্গে সরকার কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব পালন করব। সবসময় জনগণের কল্যাণে কাজ করব। যেহেতু আমি নারী তাই নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করব। ‘যেকোনো সাফল্য অর্জন করতে হলে প্রয়োজন লক্ষ্য ঠিক করে ধৈর্যের সঙ্গে পরিশ্রম করে যাওয়া। সেই সঙ্গে নিয়মিত প্রার্থনা করা। তবেই সফলতা আসবে। ধৈর্য, শ্রম এবং ভাগ্য- এই তিনের সংমিশ্রণেই আসে সফলতা’ মনে করেন নিগার সুলতানা জিনিয়া। তথ্যসূত্রঃ জাগোনিউজ