নিশাত সুলতানা একজন কলামিস্ট, শিশুসাহিত্যিক ও মানবাধিকার কর্মী। বাবা-মা, নিকটাত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবরা তাকে ‘পূরবী’ নামে ডাকেন। তিনি ২৬ জুলাই উত্তরবঙ্গের নওগাঁ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনা করেছেন নওগাঁ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, নওগাঁ সরকারি কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। কর্মজীবনের শুরু ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে। পরবর্তীতে যুক্ত হন বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সাথে।
তিনি কাজ করেছেন কনসার্ন ইউনিভার্সেল ও সেভ দ্য চিলড্রেনের গুরুত্বপূর্ণ পদে। বর্তমানে কর্মরত আছেন উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকে। ২৭তম বিসিএসে যোগদান করে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। তার রচিত শিশুতোষ বইগুলোর মধ্যে ‘নিপুর রঙিন একদিন’, ‘সবার বন্ধু পিকু’ ও ‘ক্রিকেট পাগল গেছো ভূতের বাচ্চা’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সাথেও জড়িত তিনি। তার বর্ণাঢ্য, সৃষ্টিশীল জীবনের গল্প বলেছেন জাগো নিউজকে
কেমন কেটেছে আপনার শৈশব ও কৈশোর?
নিশাত সুলতানা: আমার জন্ম উত্তরবঙ্গের নওগাঁ জেলায়। শৈশব ও কৈশোরের প্রায় পুরোটা সময়ই কেটেছে নওগাঁ জেলা শহরে। বাবার চাকরিসূত্রে মাঝখানে প্রায় চার বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় কাটিয়েছি। আমার মা-ও চাকরি করতেন, পেশায় শিক্ষক ছিলেন। আমরা দু’বোন; আমি ছোট।
তাই আদরটা একটু বেশিই পেতাম। তবে বাবা-মা ছিলেন প্রচণ্ড বাস্তববাদী। অন্যায় আবদার তারা কখনো প্রশ্রয় দেননি। আমাদের দু’বোনকেই বাস্তব জীবনের বিভিন্ন প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে শিখিয়েছিলেন। দুটি কন্যাসন্তান হওয়ার পর পুত্রসন্তান লাভের সামাজিক চাপ তারা আত্মবিশ্বাসের সাথেই মোকাবিলা করেছেন। তারা চেয়েছিলেন আমরা যেন সুশিক্ষিত আর আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠি। আমার বড় বোন নাহিদ সুলতানা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী ছিলেন।
তার ছোটবোন হিসেবে ভালো ফলাফল করার একটা চাপ স্কুলের প্রথম দিন থেকেই অনুভব করেছি; যেটি অব্যাহত ছিল আমার পুরো শিক্ষাজীবন। মা অসম্ভব পরিশ্রমী আর সংস্কৃতিমনা ছিলেন। তিনি আমাদের দু’বোনকে পড়াতেন। আমাদের গান, নাচের হাতেখড়ি তার কাছে। মনে পড়ে, প্রতি বছর স্কুলে বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণীর দিন একগাদা পুরস্কার মায়ের হাতে তুলে দিতাম আমরা। শিশু একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, একুশে পরিষদ ও আবৃত্তি পরিষদে নিয়মিত যাতায়াত ছিল আমাদের। ১৯৯৯ সালে রবীন্দ্রসংগীতের জন্য বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হই। খুব বেশি খেলাধুলা করার সুযোগ পাইনি। তবে কুমির-কুমির, বরফ-পানি, চোর-ডাকাত-দারোগা-পুলিশ, ওপেনটি বায়োস্কোপ, লুডু, নাম-দেশ-ফল-ফুল খেলতাম বন্ধু কিংবা খালাতো-মামাতো ভাই-বোনদের কাছে পেলেই।
শিক্ষা জীবনের গল্প শুনতে চাই। পড়াশোনায় কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?
নিশাত সুলতানা: পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ছিলাম। পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই নওগাঁ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েই জন্ডিসে আক্রান্ত হই। বেশ কিছুদিন আমাকে হাসপাতালে থাকতে হয়। ষষ্ঠ শ্রেণির প্রথম সাময়িক পরীক্ষা দিতে পারিনি।
কিছুটা থমকে যাই। এরপর অষ্টম শ্রেণিতে আরেকবার জন্ডিস হয়। দু’বার জন্ডিসে লেখাপড়া বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাস্থ্য বিবেচনা করে মা-বাবাও পড়ার জন্য বেশি চাপ দিতেন না। দিন দিন পিছিয়ে পড়তে থাকি। শিক্ষকদের ভয়ে শ্রেণিকক্ষে শেষ বেঞ্চে বসা শুরু করি। কিন্তু অষ্টম শ্রেণির শেষদিকে হঠাৎ নিজে উপলব্ধি করি, এভাবে বেশি দিন চলতে পারে না। আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। শুরু হয় আমার বদলে যাওয়া। নিজের চেষ্টায় আর মা-বাবা, শিক্ষকদের আন্তরিক সহযোগিতায় অষ্টম শ্রেণিতেও বৃত্তি পাই। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। এসএসসি পরীক্ষায় রাজশাহী বিভাগ থেকে সম্মিলিত মেধাতালিকায় অষ্টম স্থান অধিকার করি। নওগাঁ সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। সেখান থেকেই সম্পন্ন করি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর।
বাবাকে আমরা পেয়েছি খুব কাছের বন্ধু হিসেবে। লেখাপড়ায় তিনি প্রবলভাবে উৎসাহ দিতেন। আরেকজন শিক্ষকের নামোল্লেখ না করলেই নয়। তিনি আমার ইংরেজি বিষয়ের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মির্জা নজরুল ইসলাম। তিনি আমার মাঝে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলেছিলেন, শিখিয়েছিলেন স্বপ্ন দেখতে। পারিবারিক দিক দেকে পড়াশোনার জন্য কখনোই কোন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হইনি। তবে কলেজ জীবনে এক বখাটে ছেলে কলেজে আসা-যাওয়ার পথে রোজ আমাকে উত্যক্ত করতো। এর মাত্রা দিন দিন বাড়তে থাকে। সেসময় জীবন একেবারে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। শেষপর্যন্ত নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সাময়িকভাবে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে মনের দিক থেকে প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয়ী ছিলাম। শিক্ষকদের সহযোগিতা পেয়েছি সবসময়। মেধাতালিকায় স্থান না করতে পারলেও কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হই এইচএসসি পরীক্ষায়। আজও মনে হয়, সেই বখাটের উপদ্রব না থাকলে এইচএসসি পরীক্ষায় হয়তো আরও ভালো ফলাফল করতে পারতাম।
দেশ নিয়ে কী কী স্বপ্ন দেখছেন?
নিশাত সুলতানা: আমি সবচেয়ে বেশি স্বপ্ন দেখি শিশুদের নিয়ে। তরুণ প্রজন্ম নিয়েও আমি দারুণ আশাবাদী। অনেকেই তরুণদের নিয়ে হতাশার কথা বলেন। কিন্তু আমার মনে হয়, তরুণরা সঠিক পথেই আছেন। সম্প্রতি সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে ছাত্র আন্দোলন আমাদের নিশ্চিতভাবেই জানিয়ে দিয়েছে সত্য সুন্দর আর কল্যাণের জন্য তারা প্রয়োজনে গর্জে উঠতে জানে। এখন প্রয়োজন তথ্যপ্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহারকে নিশ্চিত করা। আত্মনির্ভরশীল হওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি বিকল্প ক্ষেত্র যেমন কারিগরী শিক্ষাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজন নিজের দক্ষতা আর জ্ঞানকে যুগপোযোগী রাখা। এখনকার ছেলে-মেয়েদের বই পড়ার অভ্যাস নেই বললেই চলে। আমার মনে হয়, মনোজগতের ইতিবাচক পরিবর্তনে বই পড়ার অভ্যাসের কোন বিকল্প নেই। দেশ নিয়ে তাই অনেক ইতিবাচক স্বপ্ন দেখি আমি।