বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশের কমিউনিকেশন ও মিডিয়া ম্যানেজার ওমর সেরনিয়াবাত জানান, এনজিওগুলো সাধারণত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে। মানুষের মৌলিক অধিকার যেমন, খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি নিয়ে যেমন কাজ করে এনজিও, তেমনি ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর উন্নয়ন, পরিবেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তন, উন্নয়ন কর্মসূচি, ক্ষদ্রঋণ, এইডস, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি ও বিভিন্ন গবেষণা পরিচালনার জন্য কাজ করে। অনেক এনজিওর কাজ বিশেষ এলাকাভিত্তিক হয়ে থাকে। যেমন-বস্তি এলাকা, চরাঞ্চল, উপকূলীয় এলাকা, পার্বত্যাঞ্চল, হাওরাঞ্চল। কিছু এনজিও বিশেষ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করে। যেমন-প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী, পথশিশু, শ্রমজীবী শিশু, নির্যাতিতা নারী।
কোথায় কেমন সুযোগ
ব্র্যাকের মানবসম্পদ বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার নূরন নবী আজাদ জানান, এনজিওগুলোতে বিভিন্ন বিভাগে কাজের সুযোগ রয়েছে। যেমন-গবেষণা, উন্নয়ন, প্রোগ্রাম, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিভাগ, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও হিসাবরক্ষণ বিভাগ। আমাদের এখানে নারী-পুরুষ সবাই সমান সুযোগ পেয়ে থাকে। তবে মাঠপর্যায়ে নারীদের সঙ্গে কাজ করার জন্য সাধারণত নারীকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আশার অ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর (কমিউনিকেশন) হাবিবুর রহমান জানান, প্রতিবছর আশায় মাঠপর্যায়ে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অনেক কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়।
কোন পদে কী যোগ্যতা
অ্যাকশনএইডের মানবসম্পদ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পল্লব কুমার বসাদ জানান, মাঠপর্যায়ে কাজের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি বা এইচএসসি পাস হলেই হয়। মাঝারি লেভেলের কর্মকর্তা পদে চাওয়া হয় স্নাতক বা স্নাতকোত্তর। থাকতে হয় অভিজ্ঞতা। অনেক এনজিওতে ইংরেজি ও তথ্যপ্রযুুক্তি দক্ষতা চাওয়া হয়। অনেক এনজিওর কার্যক্রম আছে বিদেশেও। ভালো ইংরেজি জানা থাকলে সেখানে পাঠানো হতে পারে। কম্পিউটারে দক্ষতার ক্ষেত্রে প্রয়োজন এমএস ওয়ার্ড, এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট। এ ছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহারটাও জানতে হয়।
বিষয় কোনো বিষয় নয়!
কী বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, এ চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। ইতিহাসে স্নাতকোত্তর শেষ করে মামুনর রশিদ প্রজেক্ট অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছেন ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশে। তিনি জানান, যেকোনো বিষয়ে পড়ে এনজিওতে কাজ করা যায়, তবে দরকার পরিবেশের সঙ্গে খাপখাইয়ে নেওয়ার মানসিকতা।
নূরন নবী আজাদ জানান, আমাদের এখানে সব বিভাগ থেকেই নিয়োগ পান। তবে কাজের ধরন অনুযায়ী সমাজকল্যাণ, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, লোকপ্রশাসন, উন্নয়ন অধ্যয়নসহ সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অন্তর্ভুর্ক্ত বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়ে থাকে। গবেষণার ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় গণিত ও পরিসংখ্যান। জলবায়ু পরিবর্তনের গবেষণার জন্য ভূগোল, পরিবেশবিদ্যা, ভূতত্ত্বের চাহিদা বেশি। কৃষি গবেষণার জন্য কৃষি বিষয়ে ডিগ্রিধারীদের বেশি সুযোগ। বিবিএ, এমবিএ ডিগ্রিধারীদের কাজের ক্ষেত্র হিসাব বিভাগে এবং ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম। অনেক এনজিও স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে থাকে, চিকিৎসকদের এখানে কাজ করার অনেক সুযোগ। এনজিওগুলোতে অবকাঠামোগত উন্নয়নমূলক কাজে প্রকৌশলীও নিয়োগ দেওয়া হয়। নারীদের নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থা নিয়োগ দেয় আইনজীবী।
প্রশ্ন যখন অভিজ্ঞতার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী অমলেন্দু কোচ অভিজ্ঞতার জন্য কাজ করেছেন ইমিনসি নামক এনজিওতে। তিনি জানান, অভিজ্ঞতার জন্য বিভিন্ন এনজিওতে ইন্টার্নশিপ করা যায়। ইন্টার্নশিপের সুযোগ আছে ব্র্যাক, অ্যাকশনএইড, মুসলিমএইড, কেয়ারসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে। বিনা বেতনে কাজ করার বিনিময়ে অভিজ্ঞতার সনদ দেয় অনেক এনজিও। বিভিন্ন জব সাইট ও ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করে। নূরন নবী আজাদ জানান, ব্র্যাকে এন্ট্রি লেভেলে প্রশিক্ষণ আছে কি না দেখা হয় না। চাকরি পাওয়ার পর আমরাই অভ্যন্তরীণভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। তবে ছাত্রাবস্থায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থাকলে সেটিও বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে ধরা হয়।
নিয়োগ প্রক্রিয়া
এনজিওগুলো জবসাইট ও দৈনিক পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয় বিজ্ঞপ্তি। সরাসরি, মেইল বা ডাকযোগে সিভি পাঠাতে হয় প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগ বরাবর। বিজ্ঞপ্তি না থাকলেও নিজ উদ্যোগে সিভি জমা দিতে পারেন।
মুসলিমএইডের মানবসম্পদ বিভাগের কো-অর্ডিনেটর আশরাফুল আলম জানান, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে কর্মী বাছাই করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় যারা সিভি জমা দেন, তাঁদের মধ্যে থেকেও নিয়োগ দেওয়া হয়।
এনজিওতে মাঠপর্যায়ে কাজ বেশি। কাজ করতে হলে থাকতে হবে সবার সঙ্গে মেশার ইচ্ছা, সমাজ উন্নয়নে উদ্যোগী মনোভাব। শুরুতে দুর্গম এলাকায় পাঠানো হতে পারে। সব এলাকায় কাজ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। মাঠপর্যায়ের কর্মীদের জানতে হয় বাইসাইকেল ও মোটরবাইক চালনা।
সুযোগ-সুবিধা মন্দ না
দেশীয় এনজিওগুলোতে এন্ট্রি লেভেলে কর্মীরা বেতন পান ৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা। বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত খরচ, উৎসব ভাতা, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও বিমা সুবিধাও পান কর্মীরা। প্রথম দিকে বেতন কম থাকলেও পরবর্তী সময়ে পদোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে বেতন ও সুযোগ-সুবিধা। এনজিওর পদোন্নতির ধরনটা অন্যান্য সেক্টর থেকে আলাদা। বেশির ভাগ এনজিওতে সময়ভিত্তিক না হয়ে পদোন্নতি দেওয়া হয় পারফরমেন্সভিত্তিক। তাই সারা বছর ধরে চলে কর্মীদের কর্মদক্ষতার মূল্যায়ন।
এনজিওতে বেতনকাঠামো অনেকটাই নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের নীতিমালার ওপর।
শেরপুরের ঝিনাইগাতীর গ্রামীণ ব্যাংক শাখার ব্যবস্থাপক মো. হাবিবুর রহমান জানান, ধৈর্য ও কঠোর পরিশ্রম করলে এই সেক্টরে অনেক সম্ভাবনা। দক্ষতার সঙ্গে ৩-৪ বছর কাজ করতে পারলে আন্তর্জাতিক বা শীর্ষস্থানীয় জাতীয় সংস্থাগুলোতে মোটা অঙ্কের বেতনে চাকরি পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোতে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি ৮০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বেতন পেতে পারেন।
একটুখানি সতর্কতা
কোনো বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করতে চাইলে প্রথমেই ওই সংস্থা সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজ নিতে হবে। পল্লব কুমার বসাদ জানান, খোঁজখবর না নিয়ে কাজ শুরু করলে অনেক সময় প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। দেখতে হবে এনজিওর সামাজিক পরিচিতি কতটুকু, কোন ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করে, রেজিস্ট্রেশন আছে কি না এবং চাকরি দেওয়ার সময় কোনো জামানত নেয় কি না।