শুরুটা করেছিলাম নিজের উপর এক ধরণের রাগ আর অভিমান থেকে। নিজেকে অসীম কষ্ট দেয়ার জন্য। নিজেকে কষ্ট দেয়া ছাড়া নিজেকে চেনা যায় না। না খেয়ে থাকার কষ্ট যে কী, সেটা না খেয়ে থাকা ছাড়া বোঝা অসম্ভব।
মানুষ অন্যের হৃদয়ে ছোরা চালিয়ে আনন্দ পায়। নিজের হৃদয়ে ছুরি চালিয়ে যে অনির্বচনীয় সুখ পাওয়া যায়, তার খোঁজ ওরা কখনও পেলো না। সেসময়ের কথাগুলি আমার ‘জীবনের সেরা সপ্তাহটির গল্প’ লেখাটিতে আছে। আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন।
আমি কোনো ধর্মীয় কারণে রোজা রাখি না। ৫ বছরের শুরুর বছরের কারণগুলি আমার ওই লেখাটিতে লিখেছি। পরের বছরে আমি চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে দেখেছি, রোজার সময়টাতে আমার আশেপাশের সবাই যখন অভুক্ত থাকছে, তখন আমাকে খেতে হয়। আমার জন্য আলাদা করে রান্না করতে হয়, কিংবা খাবার কিনে আনতে হয়। ব্যাপারটা আমার জন্য একটু অস্বস্তিকর। পাশেরজনকে অভুক্ত রেখে খাওয়া দাওয়া করা সহজ নয়। ভাবলাম, কী দরকার এতো বিব্রত হয়ে খাওয়া দাওয়া করার? মানুষ খেয়েই মরে। না খেয়ে কেউ অতো মরে না। যদি তা-ই হতো, তবে মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা যেত।
“আপনি তো রোজা রাখেন না। আপনি ‘আমাদের’ কষ্ট কী বুঝবেন?” “ভাই, এমনিতে রোজা আছি, মাথা গরম!” “রোজা রেখে এতো প্রেশার নিতে পারব না!” “ঘুমাব না তো কী করবো? রোজা আছি ভাই। শরীর কাহিল লাগছে!” জাতীয় কথাবার্তা এবং কিছু কিছু রোজাদারের অহেতুক ঔদ্ধত্য দেখে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমিও এখন থেকে রোজা রাখবো। রোজা রাখা কিংবা না রাখা তো ব্যক্তিগত অভ্যেস-অনভ্যেস, বিশ্বাস-অবিশ্বাস কিংবা ইচ্ছে-অনিচ্ছের ব্যাপার। এটা নিয়ে এতো হৈচৈ করার কী আছে? ঠিক আছে, আমিও এখন থেকে রোজা রাখবো।
সবাই যেরকম না খেয়ে থাকে, একদম সেরকম করেই। দেখিই না কী হয়! কেমন লাগে! নাহ্! কোনো লোভ থেকে নয়। নিজের জন্য স্রষ্টাকে বিরক্ত করা ছেড়ে দিয়েছি সেই ১২-১৪ বছর আগেই! যদি প্রার্থনায় কখনও কিছু চাইও বা, তবে সেটা আমার পরিবারের সদস্যদের জন্য কিংবা অন্য মানুষের জন্য। অন্য মানুষকে ভাল থাকতে দেখলে বড় ভাল লাগে। এটাই আমার ভাল থাকা!
শুরু করলাম রাখা। গত বছর পিএটিসিতে ট্রেনিংয়ের সময় এটা ছিল খুব উৎসবের একটা ব্যাপার। একসাথে সবাই মিলে সেহরিতে যাওয়া, ইফতার করা। উৎসব উৎসব ভাব! অদ্ভুতরকমের একটা আনন্দ। বিব্রত হতে হয় না, সবার সাথে মিশে থাকা যায়। নিজেকে উটকো কেউ মনে হয় না। আমিও সবার মতো, এটা ভাবতে ভালোই লাগত। “রোজা রেখে ট্রেনিং করতে ভীষণ কাহিল লাগে!” একথা কেউ বললে অনেকেই আমার নাম উচ্চারণ করে বলতেন, উনি তো রাখেন। কই, উনাকে তো কাহিল হতে দেখলাম না! উনার তো রাখাটা বাধ্যতামূলক না! তবে কেউ কেউ কিছু কথা বলে বিব্রত করতেন।
বলার ধরণেই চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে উঠত, ওসব ছিল কটূক্তি! “ভাই, নামাজটা পড়াও শুরু করে দেন। অসুবিধা কী?” “আপনি মুসলমান না হয়ে রোজা রাখতে পারেন না!” “দেখি, রোজার দোয়াটা বলেন তো?” “কী নিয়ত করলেন ভাই?” “তারাবীটা পড়েন আজকে আমাদের সাথে!” ইত্যাদি ইতাদি! অথচ আমি কারোর কোনো ক্ষতি করছিলাম না। আসলে কিছু কিছু মানুষের হৃদয় এতোটাই কলুষিত যে সেটা তাদের আচরণে তুলে ধরতে না পারলে ওরা শান্তি পায় না। যারা জানত না, তাদের কাউকেই কখনও নিজ থেকে বলিনি, আমি রোজা আছি। আমি যে বিশ্বাসেই বিশ্বাসী হই না কেন, আমি জীবন দিয়ে হলেও আপনার বিশ্বাসকে সম্মান করে যাবো—-এটাই আমার নীতি। বাঁচুন, বাঁচতে দিন—এটাই আমার একমাত্র ধর্ম।
আমার অভিজ্ঞতা বলে, রোজা রাখলে অতো কষ্ট তো হয় না, বরং ভালোই লাগে। ওই অনুভূতির কোনো ব্যাখ্যা হয় না। এটা নিয়ে বলা যায় না, লেখা যায় না, এটা স্রেফ অনুভব করতে হয়। আমি আমার ব্যক্তিগত অভিরুচি থেকেই রোজা রাখি। আর কিছুই নয়।
রোজা রেখে (আমি জানি, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটা রোজা রাখা নয়। এটা বড়োজোর না খেয়ে থাকা।) আমি যা অনুভব করি, তার সামান্যমাত্র বলছি।
এক। খাওয়া দাওয়া করাটা মস্তো বড় একটা টেনশন। সেটা থাকে না। নিজের কাজগুলি গুছিয়ে করা যায়। দুই। যাদেরকে সঙ্গতির অভাবে না খেয়ে কাটাতে হয়, তাদের কষ্টটা একটু হলেও অনুভব করা যায়। তিন। কথাবার্তায় একধরণের সংযত ভাব আসে। (এটা সারাদিন পানি না খেয়ে থাকার কারণেও হতে পারে।)
চার। সুন্দর সুন্দর ভাবনা মাথায় আসে। যারা বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক কারণে কষ্টে আছে, তাদের কষ্টটা একটু হলেও মাথায় আসে। কষ্ট অনুভব করা ছাড়া মানুষ হওয়া অসম্ভব। জীবনে কিছু না পাওয়ার চাইতে কষ্ট পাওয়াও ভাল।
পাঁচ। মানুষের প্রতি সম্মানবোধ অনেক বেড়ে যায়। অন্য মানুষের প্রতি সম্মানবোধ যত বাড়ে, ততই নিজের ব্যক্তিত্ব উন্নত হয়। সকল ধর্মের প্রতি সহনশীল ও উদার মানসিকতা তৈরি হয়।
ছয়। আত্মসম্মানবোধ, আত্মনিয়ন্ত্রণ আর আত্মবিশ্বাস বাড়ে। এই তিনটি যার মধ্যে যত বেশি, সে তত বেশি শক্তিশালী মানুষ।
সাত। মানসিক শক্তি অনেক অনেক বেড়ে যায়। মানুষ সামনের দিকে এগিয়ে যায় গায়ের শক্তিতে নয়, মনের শক্তিতে।
আট। রাগ কমে। (কখনও কখনও অভিমান বাড়ে।) ঔদ্ধত্য কমে। উদ্ধত হওয়া মূলত নিজের দুর্বলতাগুলিকে ঢাকার একটা টেকনিক। কোনো ঘিলুহীন বেয়াদব জীবনে কোনো কিছু করতে পেরেছে—আমি আমার জীবনে কখনও এমনটা দেখিনি।
নয়। প্রতিদিনের কাজকর্মের গুণগত মান বাড়ে। লোকের সাথে ব্যবহার আরও ভাল হয়। উপবাসযাপন মানুষকে সংযত করে। এটার একটা প্রতিফলন প্রতিদিনের কাজেকর্মে স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
দশ। অন্যের অনুভূতির সাথে একাত্মবোধ তৈরি হয়। (ইংরেজিতে এটাকে empathy বলে।) শুধু ধর্মের কারণে একটা মানুষ ভিন্নভাবে ভাববে কেন? মানুষ তো মানুষই, না? পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের চাওয়া এবং না-চাওয়াগুলি কমবেশি একইরকমের।
আমার মধ্যে এখনও পর্যন্ত ‘কখন ইফতারের সময় হবে?’ ‘কখন আজান দিবে?’ এই জাতীয় ছটফটানি কাজ করে না। বরং সন্ধ্যায় আজান শোনার পর ধীরেসুস্থে হাতমুখ ধুয়ে ইফতার করতে শুরু করি। ওই সময়টা খুবই পবিত্র। সেসময়ে খুবই প্রশান্তিময় খাওয়াদাওয়া। সত্যিই অদ্ভুতরকমের শান্তি কাজ করে শরীরে, মনে। রাতে ডিনার করি না। মুভি দেখি, বই পড়ি, ফেসবুকিং করি, লেখালেখি করি, গান শুনি আর সেহরির জন্য অপেক্ষা করি।
লেখক: সুশান্ত পাল, ৩০তম বিসিএস পরীক্ষায় ১ম স্থান অধিকারী এবং জননন্দিত মোটিভেশনাল বক্তা।