বাবা-শ্বশুর ও শাশুড়ি বিসিএস ক্যাডার, ৪৮তম বিসিএসে দ্বিতীয় ডা. মাহমুদ শান্ত

সম্প্রতি ৪৮তম বিশেষ বিসিএসের ফলাফল প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ এই বিসিএসে সহকারী সার্জন পদে ২ হাজার ৮২০ জন এবং সহকারী ডেন্টাল সার্জন পদে ৩০০ জনকে সুপারিশ করা হয়েছে। এতে দ্বিতীয় হয়েছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের (মমেক) ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ডা. মাহমুদ শান্ত। ২০১৬ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। বর্তমানে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) হেপাটোলজি বিভাগের রেসিডেন্ট। এফসিপিএস পার্ট-১ করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। বিসিএসের সাফল্য ও প্রস্তুতিসহ নানান বিষয়ে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথা বলেছেন ডা. মাহমুদ শান্ত, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নবাব আব্দুর রহিম।

আপনার সাফল্যের গল্প শুনতে চাই
ডা. মাহমুদ শান্ত: সর্বপ্রথম হচ্ছে আল্লাহর রহমত, আল্লাহ আমাকে এটির জন্য পছন্দ করেছেন। আমার ধারণা ছিল আমি সেরা দশে থাকব। কিন্তু সত্য কথা বলতে, আমি নিজেও ভাবিনি যে দ্বিতীয় হয়ে যাব। পরীক্ষায় যখন উত্তর করি, আমি ১৫০ এর মতো নিশ্চিত ছিলাম। পরে মোটামুটি আরও ২০-২৩টা ৫০/৫০ বা অনিশ্চিত থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর দেই। সে হিসেবে ২০০ নম্বরের মধ্যে ১৭০ এর মতো থাকে। আর ভাইভাটা মোটামুটি ভালো হয়েছে। তখন আমাকে অনেকেই বলেছে, ভালো অবস্থানে থাকবে। আল্লাহর অশেষ রহমত। তবে প্রথম বা দ্বিতীয়, এটা তো কিছুই না; একটা স্বীকৃতি মাত্র। এ ছাড়া আমি আমার মা-বাবার প্রতিও অনেক কৃতজ্ঞ।

বিসিএসের প্রস্তুতি সম্পর্কে বলুন
ডা. মাহমুদ শান্ত: এর আগে ৪৫ ও ৪৬তম বিসিএস আমার দেওয়া ছিল। ইন্টার্নশিপ চলাকালে প্রথম বিসিএস দিয়েছিলাম। এ ছাড়া ২০২৪-২৫ সেশনে নভেম্বরে রেসিডেন্সি করার সুযোগ পাই। আর এফসিপিএস পার্ট-১ করা আছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে। পাশাপাশি একটা কোচিংও করাই। এসব কারণে স্পেশালের যে ১০০ নম্বর, সেটা আমার জন্য সহজ হয়েছে। আর জেনারেলের প্রিপারেশনও নেওয়া ছিল, কারণ ৪৫তম বিসিএস দেওয়া ছিল, তখন থেকেই নিয়মিত বিসিএস নিয়ে পড়তাম। এজন্য জেনারেল পার্টের একটা ভালো প্রিপারেশন ছিল।

চিকিৎসা পেশায় আসার পিছনে কোনটি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে?
ডা. মাহমুদ শান্ত: আমার আব্বা বিসিএস ক্যাডার। মূলত অনুপ্রেরণা ছিল যে আব্বার মতো হব। আব্বু সব সময় অনুপ্রেরণা দিতেন। মেডিকেলে আসা আম্মুর কারণে, আর বিসিএসটা দেওয়া আব্বুর কারণে। আব্বা-আম্মা, শ্বশুর-শাশুড়ি এই চারজনের মধ্যে তিনজনই বিসিএস ক্যাডার। এজন্য বিসিএস কেমন হয়, এটা সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই ধারণা ছিল। আর বাংলাদেশে চাকরির জন্য জব সিকিউরিটিসহ কিছু ক্ষেত্রে বিসিএসটা অত্যাবশ্যক বলা যায়। এজন্য ক্রেজটা আগ থেকেই ছিল। এটি পরিপূর্ণতা পেল বিভিন্ন অনুপ্রেরণা থেকে। আর আমার প্রত্যেকটা পরীক্ষার সময় আম্মা রোজা রাখতেন, এখনও রাখেন। এটাও আমার একটা বড় অনুপ্রেরণা, বড় মোটিভেশন।

একটু অবাক হবেন, ৪৫তম বিসিএসে আমার প্রথম চয়েস ছিল পুলিশ ক্যাডার। আমি যখন ওই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার জন্য সময় দেই, তখন চয়েস পরিবর্তন করি। কারণ আমি বড় ভাই কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলি, তারা অনেকেই পরামর্শ দিয়েছে। আমি যেহেতু সারাজীবন ক্লিনিক্যাল পড়াশোনা করেছি, ডাক্তারি রিলেটেড, এখানেই থাকতে চাই। ওখানে (পুলিশ ক্যাডার) গেলে তো আমলা হতে হবে, বা রোগীর সাথে আমার যে জীবন, সেটা আমি আসলে লিড করতে পারব না, ওই জীবনটা আমার থাকবে না। এ কারণে আমি আর ওই (৪৫তম) পরীক্ষাটা দেইনি। শুধু মেডিকেল সায়েন্সের পরীক্ষাগুলোতে অংশ নিই, বাকিগুলো আমি দেই না। প্রথমে ঝোঁক ছিল, পরে চেঞ্জ করে ফেলি, কারণ ওই দিকটা আমার সাথে যায় না।

অনেকেই ক্যাডার পরিবর্তন করে। মানুষের পছন্দ ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু আমার ৫ বছর কষ্ট করার দরকার নাই। কারণ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলাম, বুয়েটেও পেয়েছিলাম। সব মিলিয়ে আমার কারছে মনে হয়েছে আমি তো মেডিকেলই বেছে নিয়েছি। এত কষ্ট করে আসার আসলে কী দরকার।

স্কুলজীবন কেমন কেটেছে?
ডা. মাহমুদ শান্ত: আমি শরীয়তপুরের একটি সরকারি স্কুল থেকে পড়াশোনা করেছি। পরে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি উত্তীর্ণ হই। পঞ্চম শ্রেণি থেকে এইচএসসি পর্যন্ত সবগুলোতেই ট্যালেন্টপুলে স্কলারশিপ ছিল। এ ছাড়া মেডিকেলের যে পেশাগত পরীক্ষা হয়, সেগুলোতেও অনার্স মার্কস ছিল। বিতর্ক-বক্তৃতা করতাম, জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক ছিলাম। ব্যাডমিন্টনে উপজেলার মধ্যে ভালো ছিলাম, উপজেলা পর্যায়ে একবার চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলাম।

প্রতিবন্ধকতা ও সংগ্রামের গল্প শুনতে চাই
ডা. মাহমুদ শান্ত: মাঝে মাঝে হতাশা এসেছে, বিভিন্ন রকমের বাধা এসেছে। আমি বিয়েও করেছি অনেক আগে। সব মিলিয়ে সব কিছুই পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে। উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলতে, আমার যখন মেডিকেল অ্যাডমিশন টেস্ট ছিল, তখন আমার ডেঙ্গু হয়। খুব অসুস্থ ছিলাম। এমন অবস্থা হয়েছে যে বাঁচব না মরব, এরকম হয়েছে। আর আব্বা অনেক কষ্ট করেছে আমাদেরকে নিয়ে।

পরিবারের কথা বলছিলেন…
ডা. মাহমুদ শান্ত: আমার বাবা শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা, মা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমার শ্বশুর একটি সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। আর শাশুড়ি একটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ। তিনি এখনও চাকরিতে আছেন, আর বাকিরা সবাই অবসরে। অর্থাৎ মা বাদে বাকি সবাই বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তা। আর আমার স্ত্রী নন-মেডিকেল। তবে উনার বাবা এবং ভাই চিকিৎসক। আর আমার শাশুড়ি এবং আব্বা কলিগ। একই বিসিএসের কর্মকর্তা। ছোট বেলা থেকেই দুজন দুজনকে চিনতাম। মাঝখানে যোগাযোগ ছিল না। পরে বিয়ের কথাবার্তা আগায়। সিনেমাটিক বিয়ে হয় না? সেরকম আর কি, বাবার বন্ধুর মেয়ের সাথে।

নতুনদের জন্য পরামর্শ কী পরামর্শ দিবেন?
ডা. মাহমুদ শান্ত: আমার থিওরি হচ্ছে দুইটা। এক. যারা বিসিএসে আসতে চায়, তাদের শুরু থেকেই নিয়মিত থাকতে হবে। এটা তো একটা লং জার্নি। এজন্য শুরু থেকে যেটা আগে আসবে, সেটা আগে পড়তে হবে। এফসিপিএস আগে আসছে, এফসিপিএস আগে পড়বে। একই সাথে ব্যালেন্স করা খুব কঠিন। এটা অনেকে প্রশ্ন করে যে একই সাথে কিভাবে? ডিগ্রিও করছেন, এফসিপিএসও করছেন, রেসিডেন্সিও করছেন। আমার পরামর্শ হচ্ছে, রেগুলার থাকতে হবে, যখন যেটা আসে। যেমন আমার ইন্টার্নশিপ চলাকালে বিসিএসের সুযোগ পাই, বিসিএসে আমি ফোকাস করেছি। পরে এফসিপিএস আসল, এফসিপিএস করলাম। যখন রেসিডেন্সি এসেছে, রেসিডেন্সি ফোকাস করেছি।

আরেকটা হচ্ছে সিলেবাস সম্পর্কে একটা সার্বিক ধারণা থাকতে হবে। প্রত্যেকটা বিষয়ের খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানতে হবে। বিশেষ করে বিগত বছরের প্রশ্ন খুব ভালো করে সমাধান করতে হবে। সব সময় কনসেপ্ট ক্লিয়ারের (পরিষ্কার ধারণা) দিকে গুরুত্ব দিতে হবে, কখনোই মুখস্তবিদ্যা না। আর যারা মেডিকেল সায়েন্সে আছে, তাদের জন্য গণিত, মানসিক দক্ষতা, তারপরে বিজ্ঞান, এগুলোতে সহজেই ৬০ এর মধ্যে ৫৫ নম্বর তোলা যায়। এটা আমার জন্যও একটা বাড়তি সুবিধা ছিল। আমি এগুলোতে একটা দখল রাখতে পেরেছিলাম। মেডিকেল সায়েন্সের সবাই সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের, এ কারণে গণিত ও মানসিক দক্ষতা, এগুলোতে অল্পতে বেশি নম্বর তোলা যায়। আর অবশ্যই কখনোই ডিপ্রেশনে যাওয়া যাবে না।